ভারতের স্বাধীনতা মুসলমানদের রক্তে লিখিত। জনসংখ্যার অনুপাতের বিচারে ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বল্প শতাংশ হলেও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণ ছিল সে তুলনায় অনেক বেশি। দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে উৎকীর্ণ ৯৫,৩০০ স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামের মধ্যে ৬১,৯৪৫ জনের নাম মুসলিম; অর্থ্যাৎ ৬৫ শতাংশ স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন মুসলিম। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের কোরবানির ইতিহাস উদ্দেশমূলকভাবে আড়াল রাখা হয়েছে। আমরা সত্য জানতে ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকাতে পারি। প্রতিটি ভারতীয়ের উচিত ইতিহাসের অসংখ্য ঘটনা জানা এবং আমাদের সন্তানদের সত্য শেখানো।
বাস্তব ঘটনা হচ্ছে, ১৭৮০ এর দশকে ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেন হায়দর আলী ও তার পুত্র টিপু সুলতান এবং ১৭৯০ এর দশকে যুদ্ধে ব্যবহৃত মহীশূরের রকেট ছিল লোহার চোঙে তৈরি প্রথম রকেট, যা সফলতার সঙ্গে সামরিক উদ্দেশে প্রয়োগ করা হয়েছিল। হায়দর আলী ও তার পুত্র ১৭৮০ ও ১৭৯০ এর দশকে ব্রিটিশ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে রকেট ও কামান ব্যবহার করেন। প্রত্যেকে জানেন যে, ঝাঁসির রাণী তার পালিত পুত্রের অনুকূলে তার রাজ্যের অধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু আমাদের মধ্যে ক’জন এ ইতিহাস জানেন যে, বেগম হযরত মহল স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী বীর নারী, যার অবদার অকীর্তিত রয়ে গেছে, যিনি ব্রিটিশ শাসক স্যার হেনরি লরেন্সকে গুলি করেছিলেন এবং ১৮৫৭ সালের ৩০ জুন চিনহাটের চূড়ান্ত যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন? আপনারা কি জানেন যে, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠক ও নেতা ছিলেন মৌলভি আহমদউল্লাহ খান এবং সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের যারা নিহত হয়েছে, তাদের ৯০ শতাংশই ছিল মুসলিম? ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২৭ বছর বয়সী আশফাক উল্লাহ খানকে সর্বপ্রথম ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়?
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ একজন ভারতীয় পণ্ডিত ছিলেন এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উর্ধতন নেতা ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর আহবানে মদের দোকানের বিরুদ্ধে পিকেটিং এ ১৯ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ১০জনই ছিলেন মুসলিম।
ভারতের স্বাধীনতার জন্য প্রথম জোরালোভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, এবং ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধে তার নেতৃত্বই ছিল প্রধান, যার আহবানে ভারতের সকল জাতিগোষ্ঠীর সিপাহিরা ব্রিটিশ বিরুদ্ধে এক পতাকাতলে সমবেত হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে ভারতের পরলোকগত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ইয়াঙ্গুনে নির্বাসিত শেষ মোগল সম্রাটের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে যান। নিজ জন্মভূমিতে দাফনের জন্য দু’গজ জমি না পাওয়ায় দু:খ করে বাহাদুর শাহ জাফর যে কবিতা রচনা করেছিলেন, তার জবাবে রাজীব গান্ধী সমাধির দর্শক বইয়ে তার মন্তব্য লিখেছেন:
“দো গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্থান মে,
ফির তেরি কুরবানি সে উঠি আজাদি কি আওয়াজ,
বদনসীব তু নেহি জাফর,
জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত কি শান আউর শওকত মে,
আজাদি কি পয়গাম সে।”
(যদিও তুমি ভারতে দু’গজ জমি পাওনি,
তবুও তোমার আত্মত্যাগে স্বাধীনতার ধ্বনি উঠেছে,
তুমি ভাগ্যহত নও, জাফর,
ভারতের মর্যাদা ও সমৃদ্ধির সাথে ,
স্বাধীনতার বাণীর সাথে জড়িয়ে আছে তোমার নাম।)
আজাদ হিন্দ ফৌজের (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি – আইএনএ) জন্য এম, কে, এম আমির হামজা বহু লক্ষ রুপি দান করেছেন। তিনি আইএনএ’র পক্ষে প্রচারণায় নেতৃত্ব দান করেন। আজ তার পরিবার চরম দারিদ্রের মধ্যে তামিল নাড়ুও রামানাধাপুরমের এক ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে বাস করেন। মেমোন আবদুল হাবিব ইউসুফ মারফানি, স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে তার কোটি টাকার পুরো সম্পত্তি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজের তহবিলে দান করেন। শাহ নওয়াজ খান ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রধান সেনাপতি, পরবর্তীতে তিনি রাজনীতিতে আসেন ও মন্ত্রীত্ব করেন। নেতাজির প্রবাসী সরকারের ১৯টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ৫টি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা ছিলেন মুসলিম। ধনাঢ্য মুসলিম নারী মা বিভিম্মা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ৩০ লাখ রুপির অধিক দান করেছিলেন। আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বিহারের নওয়াব – এই তিন জন মিলে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। মুসলিম নারী সুরাইয়া তাইয়েবচি ভারতের বর্তমান জাতীয় পতাকার ডিজাইন তৈরি করেছেন।
মুসলমানা স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য তাদের মসজিদকে ব্যবহার করেছেন। উত্তর প্রদেশের একজন ইমাম যখন মসজিদে মুসল্লিদের উদ্দেশে ভারতের স্বাধীনতা পক্ষে বক্তৃতা করছিলেন, তখন ব্রিটিশ সৈন্যরা গুলি করে সকল মুসল্লিকে হত্যা করে। মুসলমান আটশো বছরের বেশি সময় ধরে ভারত শাসন করেছে এবং তারা ভারত থেকে কোনোকিছু নিয়ে যায়নি, যা ব্রিটিশ, ডাচ ও ফরাসিরা করেছে।
মুসলমানরা ভারতে বসবাস করেছে, ভারত শাসন করেছে এবং ভারতে মারা গেছে। তারা ভারতকে উন্নত, ঐক্যবদ্ধ ও সভ্য দেশে পরিণত করেছে শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্য, বিচার ও রাজনৈতিক-সরকারি কাঠামোর জ্ঞান আণয়ন করার মধ্য দিয়ে, যা এখনো ভারতে ব্যবস্থাপনার কাজে প্রায়োগিক পদ্ধতি হিসেবে অনুসৃত হয়।
তামিল নাড়ুতে ইসমাইল সাহেব ও মারুদা নয়াগম ব্রিটিশের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৭ বছর অব্যাহতভাবে যুদ্ধ করেছেন। তারা ব্রিটিশে হৃদয়ে ভীতির সৃষ্টি করেছিলেন। আমরা সকলেই ভি,ও,সি’র (কাপ্পালোটিয়া তামিলঝান) এর কথা জানি, যিনি ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াকু প্রথম ভারতীয় নাবিক ছিলেন। কিন্তু আমরা ক’জন ফকির মুহাম্মদ রাঠোরের কথা জানি, যিনি সেই নৌ-যুদ্ধে ভারতীয়দের ওই জাহাজটি দান করেছিলেন। ‘ভিওসি’ যখন গ্রেফতার হন, তখন তার মুক্তির দাবীতে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে মুহাম্মদ ইয়াসিন নামে এক মুসলিম ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
তিরুপ্পুর কুমারান (কোডি কাটা কুমারান) ভারতের স্বাধীন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তার সঙ্গে আরো ৭ জন গ্রেফতার হন, তাদের প্রত্যেকে ছিলেন মুসলিম – আবদুল লতিফ, আকবর আলী, মহীউদ্দিন খান, ভাবু সাহাব, আবদুল লতিফ (২) ও শেখ বাবা সাহেব।
কেউ ইচ্ছা করলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের আত্মত্যাগের ওপর হাজার হাজার পৃষ্ঠার গ্রন্থ রচনা করতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাম্প্রদায়িক চরমপন্থীদের আধিপত্য, উগ্র ধর্মান্ধ হিন্দুরা এসব সত্যকে আড়াল করে রেখেছে এবং ভারতের ইতিহাস গ্রন্থে ইতিহাসকে ভ্রান্তভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বাস্তবে ভোটকে নিরাপদ করার উদ্দেশে জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে রাখতে বিকৃত অসত্য ইতিহাস তৈরি করা হয়েছে। সেজন্যে দেশপ্রেমিক ভারতীয়দের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তারা অসৎ রাজনীতিবিদদের শিকারে পরিণত না হন এবং একটি শক্তিশালী ও প্রগতিশীল জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সকল নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজ করেন। (ফেসবুক ওয়াল থেকে)
খুলনা গেজেট/এনএম